কাঁঠাল বাংলাদেশের জাতীয় ফল। পুষ্টিগুণে ভরপুর তাইতো এটি ফলের মধ্যে গুনের রাজা হিসেবে স্বীকৃত। কাঁঠালে আছে অধিক পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও বিভিন্ন ভিটামিন যা মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজন। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা কাঁঠালে শে^তসার ৯.৪ গ্রাম, আমিষ ২.৬ গ্রাম, পটাশিয়াম ২৪৬ গ্রাম, খনিজ দ্রব্য ০.৯ গ্রাম, পটাশিয়াম ২৪৬ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৯৭ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫০ মিলিগ্রাম, লৌহ ১৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ’সি’ ৫.৯০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ’এ’ ৩০ আ.এ., স্টার্চ ১৬.৫৬% এবং কাঁঠালের বীজে শে^তসার ২৫.৮ গ্রাম, আমিষ ৬.৬ গ্রাম, খনিজ দ্রব্য ১.২ গ্রাম, ফসফরাস ২৮ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ২১ মিলিগ্রাম, লৌহ ১.৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ’এ’ ১৭ আ.এ., স্টার্চ ২২% বিদ্যমান যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত দরকার। কাঁচা কাঁঠাল রোগ ব্যাধি উপশমে যেমন কার্যকর, অন্যদিকে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় অনেকগুন। এটি ক্যান্সারের মোকাবেলায়ও সাহায্য করে। এতে আছে বিপুল পরিমাণে খনিজ উপাদান যা হাড়ের গঠন ও হাড় শক্তিশালীকরণে এবং রক্তে শর্করা বা চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। কাঁচা কাঁঠালে আছে শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রি-রেডিকেলস থেকে রক্ষা করে। প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা কাঁঠাল থেকে ৫৩ কিলোক্যালরি এবং কাঁঠালের বীজ থেকে ১৩০ কিলোক্যালরি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান কাঁঠাল থেকে পাওয়া সম্ভব। আবার অনেক খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞানী চেহারায় লাবন্য দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য কাঁঠাল খাওয়ার পরামর্শ দেন। উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল ও ভুটানের জনসাধারণ কাঁচা কাঁঠাল সারা বছর সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে। ভারতের কেরালায় ১০০ ধরনের কাঁচা কাঁঠালের খাদ্য সামগ্রী বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও ফুড সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে বছরব্যাপী পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে প্রায় সব এলাকায় কম বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়ে থাকে। অঞ্চলগুলোর মধ্যে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, রাজশাহী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুঁরগাও, যশোর, খুলনা, সুনামগঞ্জ, পার্বত্যচট্রগ্রামে উল্লেখযোগ্য পরিমান ও উৎকৃষ্টমানের কাঁঠাল উৎপন্ন হয়ে থাকে। ভরা মৌসুমে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্রই রাস্তাঘাটে, ভ্যানে-রিক্সায়, অটোরিক্সা, টেম্পু, ট্রাক ও রাস্তার মোড়ে ও বাজারে ক্ষুদ্র চাষী, ব্যবসায়ী, আড়ৎদার, বেপারী ও পাইকারী বিক্রেতাদের স্তুপ করে বিক্রয় করতে দেখা যায়। এই চিত্রটি প্রায় প্রতিবছরই একইরকম ও দাম খুব কম হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত হ্যদয়ে কাঁঠাল চাষী ও উদ্যোক্তাদের কম মূল্যে বিক্রয় করতে দেখা যায় বা বিক্রয় করতে একরকম বাধ্য হয়ে থাকেন। গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় দেশে কাঠাঁলের সংগ্রহোত্তর ক্ষতির পরিমান প্রায় ২৫ – ৪৫ ভাগ বা কখনও কখনও এই অপচয়ের পরিমান অনেক বেশী হয়ে থাকে। এক প্রতিবেদনে লক্ষ্য করা যায় আমাদের দেশে প্রতিবছর ৫০০ কোটি টাকার উপরে কাঠাঁলের অপচয় হয়ে থাকে। কৃষক তার ন্যায্য মুল্য না পাওয়ায় উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে বলে অনেক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা যায়। আরও লক্ষ্যনীয় যে, কৃষক সময়মত বিক্রয় করতে না পারা ও ন্যায্য মুল্য নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকে কাঁঠাল গাছ বা কাঠাঁলের বাগান কেটে ফেলছেন ও এর পরিবর্তে অন্য ফসল বিশেষত: উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করছেন। দেশের অধিকাংশ মানুষই কাঁঠাল বলতে পাকা কাঁঠালকে খাবার হিসেবে গণ্য করে থাকে ফলে প্রযুক্তি জ্ঞান না থাকা ও সচেতনতার অভাবে কাঁঠাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই।
গাজীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী ও আড়ৎদারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কাঁঠালকে শুধুমাত্র পাকা ফল হিসেবে খাওয়ার কারণে এটি যখন পাকঁতে শুরু করে তখন একসাথে বেশি ভাগ কাঁঠালই পেকে যায়। ফলে সেই সময় গাছ হতে ৩০-৪০ ভাগ কাঁঠাল প্রাকৃতিক ভাবে পড়ে যায় যা খাওয়ার উপযোগী থাকে না অর্থাৎ ব্যাপক কাঁঠাল এক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে থাকে। সে সময় অনেকের মতে গরু বা পশু পাখিও পাকা কাঁঠাল খায় না। এক্ষেত্রে শুরুতেই কাঁচা কাঁঠালের ব্যবহার বাড়াতে এক তৃতীয়াংশ বা অর্ধেক পরিমান কাঁঠাল গাছ হতে পেড়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করা হলে খাদ্য ও পুষ্ঠি নিরাপত্তায় যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে তেমনি কাঁঠালের অপচয় রোধেও সহায়তা করবে। এছাড়াও কাঁঠাল উৎপাদনকারী কৃষক শুরুতেই বিক্রয় মূল্য বেশি পাবে যা ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতেও সহায়তা করবে। কাঁঠালকে বাণিজ্যিকীকরণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এবং পরিচর্যা ও প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য সামগ্রী তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করা হলে এ ফলটিকে সারা বছর খাওয়ার টেবিলে পাওয়া যাবে।
কাঁচা কাঁঠালের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে এবং অপচয় কমাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কেজিএফ এর অর্থায়নে পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ ও নিউভিশন সলিউ্যশনস্ লিমিটেড যৌথভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট, ফ্রোজেন, আচার, রেডি-টু-কুক প্রডাক্টসহ অন্যান্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে এবং উদ্ভাবিত প্রযুক্তি উপকারভোগী ব্যক্তিবর্গের মাঝে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এতে করে অনেক কৃষক, কৃষাণী, উদ্যোক্তা বিশেষ করে কুটির শিল্প পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরি হতে শুরু করেছে এবং মহিলা উদ্যোক্তা নিজ এলাকায়, ভ্যান, রিক্সা যোগে সরাসরি কাঁচা কাঁঠালের ফ্রেশকাট পণ্য বিক্রয় করছে। এছাড়াও উদ্যোক্তাগণকে বিপণনে সহযোগিতা করাতে তারা সুপার মার্কেট, সুপার সপ ও বিভিন্ন ফুড ভেন্ডারদের নিকট কাঁচা কাঁঠালের তৈরিকৃত খাদ্য সামগ্রী বিক্রয় করছে এবং জনসচেতনতামূলক কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে দিন দিন এর চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উদ্যোক্তাদের নিকট থেকে জানা যায়। গবেষকবৃন্দ মনে করেন, কাঁঠালকে সঠিকভাবে কাঁচা থেকে ব্যবহার করা গেলে আমাদের দেশেই থাইল্যান্ডের বা ভিয়েতনামের ন্যায় কাঁঠালের চিপস্, ভেজিটেবল মিট, ফ্রেশ-কাট, ফ্রোজেন, রেডি-টু-কুক, আচারসহ বহুবিধ উৎকৃষ্টমানের ও মুখরোচক খাদ্য সামগ্রী বছর জুড়েই অনায়াসে তৈরি করা যাবে। কাঁচা কাঁঠালের কাটলেট, ভেজিটেবল রোল, সিংগারা, সমুচা, পাপড় ইত্যাদি বিবিধ খাদ্য সামগ্রী তৈরি করা যায়। কাঁচা কাঁঠালের পাউডার বা আটা ঔষধ শিল্পে, শিশুর খাদ্য ও ফর্টিফিকেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন খাদ্যে মূল্য সংযোজন করে পুষ্ঠি উন্নয়ন এখন সময়ের দাবি। এছাড়াও ভর্তা, মুগ ও ছোলা ডালে কাঁচা কাঁঠাল ব্যবহার করলে খাদ্যের গুনগতমান যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি খাদ্য ও পুষ্ঠি নিরাপত্তা বিধানেও সহায়তা করবে নিঃসন্দেহে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর তথ্য মোতাবেক বিশ্বে বছরে প্রায় ৩৭ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয় যার অধিকাংশই উৎপাদিত হয় ভারতে (১৮ লাখ টন) এর পরের অবস্থান বাংলাদেশ (১০ লাখ টন)। পুষ্টি বিবেচনায় চীন, জাপান, মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশই কাঁঠালকে প্রক্রিয়াজাতকরণ কাজে ব্যবহার করায় উৎপাদন চলমান রাখতে বিভিন্ন দেশ হতে কাঁঠাল আমদানিও করছে। এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্টমানের ও সুনির্দিষ্ট জাত উদ্ভাবন এবং সঠিক পরিপক্কতা নির্বাচনের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানীর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে যা দেশের কৃষক ও উদ্যোক্তাকে উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করবে। উপমহাদেশের কাঁঠালের জাতের মধ্যে পরিচিত জাতগুলো হচ্ছে গালা, খাজা ও দোরোসা বা রস খাজা। কাঁঠালকে জনপ্রিয় ও যথাযথ ব্যবহার বৃদ্ধি করার প্রয়াসে বিএআরআই এ পর্যন্ত ৩ টি জাত বারি কাঁঠাল-১, বারি কাঁঠাল-২ ও বারি কাঁঠাল-৩ উদ্ভাবন করেছে ।
দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের খুব অল্প পরিমানে বিদেশে রপ্তানী হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশী। ডিএই-এর তথ্য মতে কাঁঠালের রপ্তানী পূর্বের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর রপ্তানী বৃদ্ধির যথেস্ট সুযোগ রয়েছে, গত ২০১৯-২০২০ সালে কাঁঠালের রফতানি ছিল প্রায় ১০০০ টন। আমাদের দেশের কাঁঠালের মধ্যে হবিগঞ্জের বড় ও ভালমানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। উত্তম কৃষি চর্যা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্কতা নির্ধারন, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউজ সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গন্ডী পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানী বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে যা কৃষকের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে তেমনি অধিক পুষ্ঠি সমৃদ্ধ ফল কাঠাঁলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। সর্বোপরি খাদ্য ও পুষ্ঠি নিরাপত্তা বিধানসহ দেশের অর্থনীতিকে বেগমান করবে।
লেখক: ড. মো: গোলাম ফেরদৌস চৌধুরী, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও খাদ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষক, পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি বিভাগ, বিএআরআই, গাজীপুর।